কোনও প্রতিষ্ঠানের পরিচালন ব্যবস্থা[] (ইংরেজি: Governance) বলতে কোনও সংগঠিত ব্যক্তিদলের অভ্যন্তরীণ সম্পর্ক, আন্তঃক্রিয়া, ক্ষমতার গতিশীলতা ও যোগাযোগের ফলশ্রুতিতে গড়ে ওঠা এমন কিছু প্রক্রিয়া, কার্যাবলী, কাঠামো, নিয়ম, বিধি ও আদর্শমানের একটি সামগ্রিক জটিল ব্যবস্থা বা পরিকাঠামোকে বোঝায়, যেটি এক দিকে দলের বিভিন্ন ব্যক্তির গ্রহণযোগ্য আচরণ ও চর্চার সীমা নির্ধারণ করে এবং নিয়মাবলী ও দিকনির্দেশনা সৃষ্টি ও বলবৎকরণের মাধ্যমে তাদের সিদ্ধান্ত-গ্রহণ প্রক্রিয়াগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করে, আবার অপর দিকে বিভিন্ন ব্যক্তির সামর্থ্য ও সংশ্লিষ্ট সম্পদগুলি পরিচালনা, বরাদ্দ ও সচল করে এবং দলটির সামগ্রিক অভিমুখ নির্দিষ্ট করে, যাতে দলটির সামষ্টিক প্রয়োজন, সমস্যা ও সংকটগুলিকে কার্যকরভাবে মোকাবেলা করা যায়।[][][] পরিচালন ব্যবস্থার ধারণাটি সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সত্তার (কোনও উদ্দেশ্যমূলক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তির দল) জন্য প্রযোজ্য, যার মধ্যে রাষ্ট্র ও তার সরকার, কোনও শাসিত অঞ্চল, সমাজ, সম্প্রদায়, সামাজিক দল (যেমন গোত্র বা পরিবার), কোনও আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক সংস্থা-সংগঠন, কর্পোরেশন, অলাভজনক সংস্থা, প্রকল্প দল, বাজার, জালকব্যবস্থা, এমনকি বৈশ্বিক ব্যবস্থাও অন্তর্ভুক্ত। পরিচালন ব্যবস্থা কোনও বিশেষ খাতের সাথেও সম্পর্কিত হতে পারে, যেমন ভূমি, পরিবেশ, স্বাস্থ্য, আন্তর্জাল (ইন্টারনেট), নিরাপত্তা, ইত্যাদি ক্ষেত্রে পরিচালন ব্যবস্থা থাকতে পারে। পরিচালন ব্যবস্থার আনুষ্ঠানিকতার মাত্রা কতটুকু হবে, তা প্রদত্ত সত্তার অভ্যন্তরীণ নিয়মাবলী ও অন্যান্য অনুরূপ সত্তার সাথে সেটির বাহ্যিক যোগাযোগের উপর নির্ভর করে। তাই পরিচালন ব্যবস্থা বহুসংখ্যক রূপ ধারণ করতে পারে, বহু বিভিন্ন কারণে চালিত হতে পারে এবং বহু বিভিন্ন ফলাফল প্রদান করতে পারে।

বৃহৎ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের (কর্পোরেশন) উত্তম পরিচালন ব্যবস্থার কাঠামো

অপেক্ষেকৃত ক্ষুদ্র ব্যক্তিদলগুলি অনানুষ্ঠানিক নেতৃত্ব কাঠামোর উপর নির্ভর করতে পারে। এর বিপরীতে বৃহত্তর কোনও দলের কার্যকর পরিচালন ব্যবস্থা সাধারণত একটি সঠিকভাবে কার্যক্ষম পরিচালক মণ্ডলীর (Governing body) উপর নির্ভর করে। পরিচালক মণ্ডলী হল বিশেষ কিছু আস্থাভাজন ব্যক্তির একটি দল যাদের উপর কর্তৃত্ব ন্যস্ত করা হয় ও যাদের দায়িত্ব হল নিয়মাবলীর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সেগুলি বলবৎকরণ এবং সংশ্লিষ্ট সংগঠনটির নির্বিঘ্ন কার্যকলাপের উপর নজরদারি করা; তবে এই কাজগুলি তাদেরকে পরিচালন ব্যবস্থার বৃহত্তর পরিকাঠামোর অভ্যন্তরে থেকে সম্পাদন করতে হয়। পরিচালন ব্যবস্থার সবচেয়ে আনুষ্ঠানিক ধরনটি হল কোনও দেশের বা রাষ্ট্রের সরকার, যা কর্তৃত্বের সাথে কোনও নির্দিষ্ট ভূরাজনৈতিক ব্যবস্থার (যেমন দেশ) জন্য নিয়মাবলী ও দিকনির্দেশনার মাধ্যমে অবশ্যপালনীয় সিদ্ধান্ত প্রদানের দায়িত্বে নিয়োজিত থাকে। একটি সরকার একটি গণতন্ত্র হিসেবে পরিচালিত হতে পারে, যেক্ষেত্রে নাগরিকেরা ভোট প্রদানের মাধ্যমে নির্বাচন করে কোন ব্যক্তিরা জনকল্যাণের লক্ষ্যে দেশ পরিচালনা করবে। সরকার ছাড়া অন্যান্য সত্তারও পরিচালক মণ্ডলী থাকতে পারে। এগুলি সরকার কর্তৃক স্বীকৃত আইনি সত্তা বা সংস্থা যেমন কর্পোরেশন, কোম্পানি বা অলাভকনক সংস্থা হতে পারে, যেগুলিকে একটি ক্ষুদ্র পরিচালক মণ্ডলী নির্দিষ্ট লক্ষ্য অভিমুখে পরিচালনা করতে পারে। এগুলি সামাজিক-রাজনৈতিক দল হতে পারে, যেমন রাজনৈতিক দল বা সংগঠন, গোত্র, ধর্মীয় সম্প্রদায়, এমনকি পরিবারও। রাষ্ট্রের প্রেক্ষিতে পরিচালন ব্যবস্থা কথাটি দিয়ে কীভাবে রাষ্ট্রের কর্মকাণ্ডের অবর্তমানেও ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব বিভিন্ন উপায়ে পরিব্যাপ্ত হতে পারে, সে ব্যাপারটি সম্পর্কে ক্রমবর্ধমান সচেতনতা নির্দেশ করা হয়। বিভিন্ন ধরনের বহিঃস্থ ক্রীড়ানক বা ঘটক (যাদের কোনও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা নেই) এই রাষ্ট্র পরিচালন ব্যবস্থাটির উপর প্রভাব ফেলতে পারে। এদের মধ্যে আছে তদবির গোষ্ঠী, চিন্তাকেন্দ্র, রাজনৈতিক দল, বেসরকারি সংস্থা, সম্প্রদায় ও সংবাদমাধ্যম। এছাড়া বিশ্বায়ন, সামাজিক আন্দোলন ও প্রযুক্তিগত উন্নতির মতো বহিঃস্থ নিয়ামকগুলিও এই পরিচালন ব্যবস্থার আকার পরিবর্তন করতে পারে।

কল্যাণবিচারী দৃষ্টিকোণ থেকে একটি উত্তম, কার্যকর ও ন্যায্য পরিচালন ব্যবস্থা একটি সুসংগঠিত ব্যবস্থা যেখানে অংশীজনদের স্বার্থ ও চাহিদাগুলির ন্যায্য প্রতিনিধিত্ব ঘটে। এটি দলটির লক্ষ্য, নীতি ও কর্মসূচিগুলির সূত্রায়ন, বাস্তবায়ন ও মূল্যায়নের ব্যাপারে দিকনির্দেশনা প্রদান করে ও বিভিন্ন পরিবেশ-পরিস্থিতিতে দলটির নির্বিঘ্নে কর্মকাণ্ড চালনা করা নিশ্চিত করে। স্বচ্ছতা, দায়িত্ববোধ ও জবাবদিহিতার প্রসারের মাধ্যমে এটি আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করে এবং বৃহত্তর মতের মিলের জন্য দ্বন্দ্ব-সংঘাত নিরসনের কলাকৌশল প্রয়োগ করে। এটি পরিবর্তনশীল পরিপার্শ্বিকতার সাথে খাপ খাইয়ে নিয়ে দলটিকে সামর্থ্য পুনরুদ্ধারে সাহায্য করে ও প্রতিক্রিয়াশীল করে তোলে। প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে ও ইতিবাচক ফলাফল সৃষ্টি করে এটি পরিচালক মণ্ডলীর বৈধতা ও গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি করে, যার ফলে নিয়মানুবর্তিতা, অংশিদারী দায়িত্ববোধ, সক্রিয় অংশগ্রহণ ও শেষ বিচারে অধিকতর স্থিতিশীলতা ও দীর্ঘমেয়াদী স্থায়িত্ব অর্জন সম্ভব হয়।

বহুসংখ্যক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিচালন ব্যবস্থাকে পাঠ্যবিষয় হিসেবে অধ্যয়নের সুযোগ থাকে। অনেক সামাজিক বিজ্ঞানী পরিচালন ব্যবস্থার ধারণাটির মাধ্যমে (প্রশাসন বা সরকারের পরিবর্তে) পরিচালন প্রক্রিয়াটির আলোচনা করতে পছন্দ করেন, কেননা এই ধারণাটিতে বহু বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠান ও সম্পর্কের সম্মিলন ঘটেছে।[]

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. সিটি কর্পোরেশন পরিচালন ব্যবস্থা (গভর্ন্যান্স) উন্নয়ন কৌশলপত্র ২০২০-২০৩০, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, মে ২০২০ 
  2. Bevir, Mark (২০১২)। Governance: A very short introduction। Oxford, UK: Oxford University Press। আইএসবিএন 9780191646294Governance refers, therefore, to all processes of governing, whether undertaken by a government, market, or network, whether over a family, tribe, formal or informal organization, or territory, and whether through laws, norms, power or language. Governance differs from government in that it focuses less on the state and its institutions and more on social practices and activities. 
  3. Hufty, Marc (২০১১)। "Investigating Policy Processes: The Governance Analytical Framework (GAF). In: Wiesmann, U., Hurni, H., et al. eds. Research for Sustainable Development: Foundations, Experiences, and Perspectives."। Bern: Geographica Bernensia: 403–24। 
  4. "Governance"। ২০২০-০৮-১৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৫-০২ 
  5. Pierre, Jon (২০২০)। Governance, politics and the state। B. Guy Peters (2nd সংস্করণ)। London। আইএসবিএন 978-1-350-31143-5ওসিএলসি 1165386354