বিষয়বস্তুতে চলুন

চাঁদ

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
চাঁদ ☾
পৃথিবীতে অবস্থানকারী পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে চাঁদ
বিবরণ
বিশেষণচন্দ্রীয়
কক্ষপথের বৈশিষ্ট্য
অর্ধ-মুখ্য অক্ষ৩৮৪,৩৯৯ কিমি (0.00257 জ্যোএ)
উৎকেন্দ্রিকতা০.০৫৪৯
গড় কক্ষীয় দ্রুতি১.০২২ কিমি/সে (২২৮৬ মাপ্রঘ)
নতিভূ-কক্ষের সাথে ৫.১৪৫°
(পৃথিবীর বিষুবের সাথে ১৮.২৯° এবং ২৮.৫৮° -এর মধ্যে)
উদ্বিন্দুর দ্রাঘিমাপশ্চাদপসরমান,
১৮.৬ বছরে একবার আবর্তন
যার উপগ্রহপৃথিবী
ভৌত বৈশিষ্ট্যসমূহ
গড় ব্যাসার্ধ১,৭৩৭.১০৩ কিমি (পৃথিবীর ০.২৭৩ গুণ)
বিষুবীয় ব্যাসার্ধ১,৭৩৮.১৪ কিমি (পৃথিবীর ০.২৭৩ গুণ)
মেরু ব্যাসার্ধ১,৭৩৬.০ কিমি (পৃথিবীর ০.২৭৩ গুণ)
পৃষ্ঠের ক্ষেত্রফল৩.৭৯৩×১০ কিমি² (পৃথিবীর ০.০৭৪ গুণ)
আয়তন২.১৯৫৮×১০১০ কিমি³ (পৃথিবীর ০.০২০ গুণ)
ভর৭.৩৪২×১০২২ কেজি (পৃথিবীর ০.০১২৩ গুণ)
গড় ঘনত্ব৩,৩৪৩.০ কেজি/মি
বিষুবীয় পৃষ্ঠের অভিকর্ষ
১.৬২ মি/সে (০.১৬৫৪ জি)
মুক্তি বেগ২.৩৮ কিমি/সে (৫৩২৪ মাপ্রঘ)
নাক্ষত্রিক ঘূর্ণনকাল
২৭.৩২১ ৫৮২ দিন (সঙ্কালিক)
বিষুবীয় অঞ্চলে ঘূর্ণন বেগ
৪.৬২৭ মি/সে (১০.৩৪৯ মাপ্রঘ)
অক্ষীয় ঢালভূ-কক্ষের সাথে ১.৫৪২৪°
প্রতিফলন অনুপাত০.১২
পৃষ্ঠের তাপমাত্রা ন্যূন মধ্যক সর্বোচ্চ
বিষুব ১০০ কে ২২০ কে ৩৯০ কে
৮৫°উ ৭০ কে ১৩০ কে ২৩০ কে
আপাত মান−১২.৭৪ পর্যন্ত
কৌণিক ব্যাস২৯′ থেকে ৩৩′
বায়ুমণ্ডল

চাঁদ পৃথিবীর একমাত্র প্রাকৃতিক উপগ্রহ এবং সৌর জগতের পঞ্চম বৃহত্তম উপগ্রহ। পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে চাঁদের কেন্দ্রের গড় দূরত্ব হচ্ছে ৩৮৪,৪০০ কিলোমিটার (প্রায় ২৩৮,৮৫৫ মাইল) যা পৃথিবীর ব্যাসের প্রায় ৩০ গুণ। এর অর্থ দাড়াচ্ছে, চাঁদের আয়তন পৃথিবীর আয়তনের ৫০ ভাগের ১ ভাগ। এর পৃষ্ঠে অভিকর্ষ বল পৃথিবী পৃষ্ঠে অভিকর্ষ বলের এক-ষষ্ঠাংশ। পৃথিবী পৃষ্ঠে কারও ওজন যদি ১২০ পাউন্ড হয় তা হলে চাঁদের পৃষ্ঠে তার ওজন হবে মাত্র ২০ পাউন্ড। পৃথিবী থেকে চাঁদের এই যে দূরত্ব এটা কিন্তু সবসময় এক থাকে না। কখনো বাড়ে আবার কখনো কমে। বর্তমান শতাব্দীতে চাঁদ পৃথিবীর সবচেয়ে কাছে চলে এসেছিল গত ১৯১২ সালের ৪ জানুয়ারি তারিখে। এই তারিখে পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব ছিল মাত্র ৩,৪৮,২৫৯ কিলোমিটার (২,১৬,৩৯৮ মাইল)। এই শতাব্দীতে চাঁদের সাথে পৃথিবীর দূরত্ব সর্বোচ্চ স্তরে গিয়েছিল ১৯৮৪ সালের ২রা মার্চে। এই দিনে পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব ছিল ৩,৯৮,৫৯৮ কিলোমিটার (২,৪৭,৬৭৫ মাইল)। চাঁদের বয়স প্রায় ৩৯০০ মিলিয়ন বছর। চাঁদের ব্যাস ৩,৪৭৪.২০৬ কিলোমিটার (২,১৫৯ মাইল) যা পৃথিবীর ব্যাসের এক-চতুর্থাংশের চেয়ে সামান্য বেশি। ওজন ৭.২৩×১০^১৯ (অর্থাৎ ১০ এর ডানে ১৯টি শূণ্য বসিয়ে তাকে ৭.২৩ দিয়ে গুণ করলে যা হয়)। ঘনত্ব জলের চেয়ে ৩,৩৪২ ভাগ ঘন। গতি ৩,৬৮০ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টায় (২,২৮৭ মাইল)। এটি প্রতি ২৭.৩২১ দিনে পৃথিবীর চারদিকে একটি পূর্ণ আবর্তন সম্পন্ন করে। প্রতি ২৯.৫ দিন পরপর চন্দ্র কলা ফিরে আসে অর্থাৎ একই কার্যক্রম আবার ঘটে। পৃথিবী-চাঁদ-সূর্য তন্ত্রের জ্যামিতিতে পর্যায়ক্রমিক পরিবর্তনের কারণেই চন্দ্র কলার এই পর্যানুক্রমিক আবর্তন ঘটে থাকে।

বেরিকেন্দ্র নামে পরিচিত একটি সাধারণ অক্ষের সাপেক্ষে পৃথিবী এবং চন্দ্রের ঘূর্ণনের ফলে যে মহাকর্ষীয় আকর্ষণ এবং কেন্দ্রবিমুখী বল সৃষ্টি হয় তা পৃথিবীতে জোয়ার-ভাটা সৃষ্টির জন্য অনেকাংশে দায়ী। জোয়ার-ভাটা সৃষ্টির জন্য যে পরিমাণ শক্তি শোষিত হয় তার কারণে বেরিকেন্দ্রকে কেন্দ্র করে পৃথিবী-চাঁদের যে কক্ষপথ রয়েছে তাতে বিভব শক্তি কমে যায়। এর কারণে এই দুইটি জ্যোতিষ্কের মধ্যে দূরত্ব প্রতি বছর ৩.৮ সেন্টিমিটার করে বেড়ে যায়। যতদিন না পৃথিবীতে জোয়ার-ভাটার উপর চাঁদের প্রভাব সম্পূর্ণ প্রশমিত হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত চাঁদ দূরে সরে যেতেই থাকবে এবং যেদিন প্রশমনটি ঘটবে সেদিনই চাঁদের কক্ষপথ স্থিরতা পাবে।

বাংলাদেশ থেকে চন্দ্রের ছবি

ইতিহাস

[সম্পাদনা]

প্রাচীনকালে সংস্কৃতি ছিল বিরল, বেশির ভাগ মানুষেরই নির্দিষ্ট কোনো বাসস্থান ছিল না। তারা মনে করত, চাঁদ প্রত্যেক রাত্রি মরে ছায়ার জগতে চলে যায়। অন্যান্য সংস্কৃতিতে বিশ্বাস করত যে চাঁদ সূর্যকে পিছু করছে। পিথাগোরাসের সময়ে, চাঁদকে একটি গ্রহ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। মধ্যযুগে কিছু মানুষ বিশ্বাস করত যে চাঁদ হয়তো একটি নির্ভুলভাবে মসৃণ গোলক যা অ্যারিস্টটলের তত্ত্ব সমর্থন করত এবং অন্যান্যরা মনে করত সেখানে সাগর আছে (সাগর বলতে চাঁদের উপরিতলের অন্ধকার অঞ্চলকে বোঝায় যা চিত্র শব্দতে এখনও ব্যবহার করে)। ১৬০৯ সালে গ্যালিলিও যখন তাঁর দূরবীক্ষণ চাঁদের দিকে ধরলেন, তিনি দেখলেন যে চাঁদের উপরিতল মসৃণ ছিল না। তা ক্ষুদ্র কালো রেখা, উপত্যকা, পর্বত এবং খাদের গঠিত হয়। সেই মুহূর্ত থেকে তিনি অনুভব করতে শুরু করেন যে এটি পৃথিবীর মতোই একটি কঠিন গলিত পদার্থ ছিল যা পরে এই রূপ নেয়। ১৯২০ সালেও মনে করত যে চাঁদের শ্বাস গ্রহণের উপযোগী বায়ুমণ্ডল আছে (অথবা ঐ সময় বিজ্ঞানের কাল্পনিক বানোয়াট গল্প বলত) এবং কিছু জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা একটি ক্ষুদ্র বায়ু স্তরের উপস্থিতি আছে বলে অনুমান করত কারণ চাঁদ পর্যবেক্ষণ সময় তারা অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু উড়ন্ত বস্তু দেখে ছিল। উদাহরণ হিসেবে জ্যোতির্বিজ্ঞানী আলফন্স ফ্রেসার তাঁর গবেষণামূলক আলোচনা-গ্রন্থে চাঁদের অনাকাঙ্ক্ষিত উড়ন্ত বস্তু সম্পর্কে লিখেন:

আর একটি বিস্ময়কর অনাকাঙ্ক্ষিত বস্তু ১৯২৪ সালের ১৪ই আগস্টের পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণের সময় লেনিনগ্রাদে W. Maltzew মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করেছে তারকা BD-15°6037 ৭তম ম্যাগনিটিউডের। প্রায় ২ সেকেন্ড জন্য মনে হয়েছিল চাঁদের উড়ন্ত বস্তুর (ডিস্ক) গ্রহণ অথাৎ উড়ন্ত বস্তু দ্বারা চাঁদ সম্পূর্ণ ঢেকে গিয়েছিল।

চাঁদের বসবাস করার সাথে জড়িয়ে আছে অমোচনীয় পানি এবং বায়ু অনুপস্থিতির সমস্যার এবং আলফন্স ফ্রেসা এই শর্তাবলিতে প্রতিবেদন করেছিলেন:

প্রথমে আমাদের জীবনের অর্থের ব্যাপারে একমত হওয়া প্রয়োজন, কেননা, যদি চাঁদে এখনও জীবাণু আশ্রয় খুব অসম্ভাব্য কারণ সেখানে পানি এবং বায়ু অস্তিত্ব এখনও পাওয়া যায়নি।

চাঁদই একমাত্র জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক বস্তু যাতে মানুষ ভ্রমণ করেছে এবং যার পৃষ্ঠতলে মানুষ অবতরণ করেছে। প্রথম যে কৃত্রিম বস্তুটি পৃথিবীর অভিকর্ষ অতিক্রম করেছিল এবং চাঁদের কাছ দিয়ে উড়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল তা হল সোভিয়েত ইউনিয়নের লুনা ১লুনা ২ প্রথবারের মত চাঁদের পৃষ্ঠতলকে প্রভাবান্বিত করেছিল। চাঁদের দূরবর্তী যে অংশটা স্বাভাবিকভাবে লুকায়িত থাকে তার প্রথম সাধারণ ছবি তুলেছিল লুনা ৩। এই তিনটি ঘটনাই সোভিয়েত ইউনিয়নের পরিচালনায় ১৯৫৯ সালে সংঘটিত হয়। ১৯৬৬ সালে লুনা ৯ প্রথমবারের মত চন্দ্রপৃষ্ঠে অবতরণ করে এবং লুনা ১০ প্রথমবারের মতো চাঁদের কক্ষপথ পরিক্রমণ করতে সমর্থ হয়। যুক্তরাষ্ট্র এদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে পাল্লা দিতে অ্যাপোলো প্রকল্প শুরু করে। পরে ১৯৬৯ সালে, অ্যাপোলো-১১ অভিযান প্রথমবারের মতো চাঁদে মনুষ্যবাহী নভোযান অবতরণ করাতে সমর্থ হয়। নিল আর্মস্ট্রং এবং বাজ অলড্রিন ছিলেন প্রথম মানুষ যাঁরা চাঁদে হেঁটেছেন । পরে আরও ১০ মানুষ কেবল চাঁদে হেঁটেছিল। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭২ সালের মধ্যে ছয়টি নভোযান চন্দ্রপৃষ্ঠে অবতরণ করে। অ্যাপোলো অভিযানের পর জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা চাঁদে মানুষ পাঠানোর সকল পরিকল্পনা ত্যাগ করে। ২০০৯ সালে প্রথম দিকে ভারত, চন্দ্রযান নামে একটি মহাকাশযান চাঁদে পাঠায়। কিন্তু প্রকল্পটি ব্যর্থ হয়। মহাকাশযান চাঁদে পৌঁছার পর পরেই তার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কিন্তু অল্প সময়ে যে তথ্য পাঠিয়েছে তা মানব জাতিকে নতুন করে আশার আলো দেখিয়েছে চাঁদে জীবের অস্তিত্ব থাকার কারণ সেখানে পানির অস্তিত্ব পাওয়া গেছে৷ তবে ২০১৯ সালের ২২ জুলাই ভারতের ইসরো, চন্দ্রযান-২ নামে পুনরায় একটি মহাকাশযানের সফল উৎক্ষেপণ করে।[]

আবর্তন

[সম্পাদনা]
চাঁদের আবর্তন

চাঁদের আবর্তনের পর্যায়কাল এবং তার কক্ষপথের পর্যায়কাল একই হওয়ায় আমরা পৃথিবী থেকে চাঁদের একই পৃষ্ঠ সবসময় দেখতে পাই। চাঁদ পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করতে ২৭ দিন ৭ ঘণ্টা ৪৩ মিনিট ১১ সেকেন্ড সময় নেয়। কিন্তু সমসাময়িক আবর্তনের ফলে পৃথিবীর পর্যবেক্ষকরা প্রায় ২৯.৫ দিন হিসেবে গণনা করে। একটি ঘণ্টা আবর্তনের পর্যায়কাল অর্ধেক ডিগ্রি দূরত্ব অতিক্রম করে। চাঁদ পৃথিবীকে যে অক্ষরেখায় পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে আবর্তন করছে, সে অক্ষরেখায় চাঁদ একদিন বা ২৪ ঘণ্টায় ১৩°কোণ অতিক্রম করে। সুতরাং পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করতে চাঁদের সময় লাগে ২৭ দিন ৭ ঘণ্টা ৪৩ মিনিট ১১ সেকেন্ড। এই জন্য আমরা পৃথিবী থেকে চাঁদের একই পৃষ্ঠ দেখে থাকি। পৃথিবী থেকে আমরা চাঁদের শতকরা প্রায় ৫৯ ভাগ দেখতে পেয়ে থাকি। চাঁদ আকাশের সবসময় একটি অঞ্চল থাকে তাকে জৌডিঅ্যাক (zodiac) বলে। যা ক্রান্তিবৃত্তের প্রায় ৮ ডিগ্রি নিচে এবং গ্রহণরেখার উপরে অবস্থান করে। চাঁদ প্রতি ২ সপ্তাহে একে অতিক্রম করে ৷ সূর্য ও পৃথিবীর কক্ষপথের সাথে চাঁদ ও পৃথিবীর কক্ষপথ প্রায় ৫ ডিগ্রি হেলে থাকে। ফলে রাতের বেলাতেও সূর্যের আলো চাঁদে প্রতিফলিত হয়ে পৃথিবীতে আসে।

নাম এবং ব্যুৎপত্তি

[সম্পাদনা]

বাংলায় চাঁদ শব্দটি সংস্কৃত শব্দ চন্দ্র থেকে এসেছে। এছাড়াও শশধর, শশী প্রভৃতিও চাঁদের সমার্থক শব্দ। চন্দ্র পৃষ্ঠের ভূমিরূপকে পৃথিবী থেকে খালি চোখে খরগোশ বা শশকের ন্যায় লাগে। তাই শশক ধারক রূপে কল্পনা করে শশধর নামটি দেওয়া হয়েছে। ইংরেজি ভাষায় পৃথিবীর একমাত্র প্রাকৃতিক উপগ্রহটির The Moon ছাড়া অন্য কোনো নাম নেই। অবশ্য অন্যান্য গ্রহের উপগ্রহের আরও নাম থাকতে দেখা যায়। মুন শব্দটি জার্মান ভাষাগোষ্ঠীর কোনো একটি থেকে এসেছে যার সাথে সম্পর্কিত রয়েছে লাতিন শব্দ mensis। মেনসিস শব্দটি মূলত প্রাক-ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার মূল me- থেকে এসেছে। এই একই মূল থেকে আবার ইংরেজি measure শব্দটি উদ্ভূত হয়েছে। মিজার শব্দটিকে বিশেষ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে, কারণ এর সাথে শব্দের মাধ্যমে বিভিন্ন পরিমাপের প্রকাশের সম্পর্ক রয়েছে। যেমন: Monday, month এবং menstrual১৬৬৫ সালের পূর্ব পর্যন্ত ইংরেজি ভাষায় মুন বলতে কেবল মাত্র চাঁদকেই বুঝাত। কিন্তু ১৬৬৫ সালে তখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত অন্যান্য গ্রহের প্রাকৃতিক উপগ্রহের ক্ষেত্রেও এই মুন শব্দটি প্রয়োগ করা শুরু হয়। মুনা শব্দের লাতিন প্রতিশব্দ হচ্ছে Luna। অন্য গ্রহের প্রাকৃতিক উপগ্রহের সাথে পৃথিবীর প্রাকৃতিক উপগ্রহের পার্থক্য করার জন্য চাঁদকে ইংরেজিতে মুন না বলে তাই অনেক সময়েই লুনা বলা হয়ে থাকে। ইংরেজিতে চাঁদের বিশেষণ হিসেবে লুনার শব্দটি ব্যবহৃত হয়। একই সাথে চাঁদের ক্ষেত্রে বিশেষণগত উপসর্গ হিসেবে seleno- এবং অনুসর্গ হিসেবে -selene ব্যবহৃত হয়। এই উপসর্গ এবং অনুসর্গ গ্রিক ভাষার শব্দ selene থেকে এসেছে যা এখন গ্রিক দেবতার নাম।

পৃথিবী-চন্দ্র সমাহার

[সম্পাদনা]

পৃথিবীর সাথে চাঁদের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক দূরত্বের দিক থেকে চিন্তা করলে এরা একে-অপরের বেশ নিকটে অবস্থিত, আর তাই মহাকর্ষীয় আকর্ষণজনিত প্রভাবও বেশি। এই প্রভাবের প্রধানতম অবদান হচ্ছে জোয়ার-ভাটা

জোয়ার-ভাটা

[সম্পাদনা]

পৃথিবী-চন্দ্র সমাহারের অবিরত পরিবর্তন হচ্ছে। জোয়ার-ভাটার সাথে এর সম্পর্ক রয়েছে। চাঁদের আকর্ষণে চাঁদের দিকে অবস্থিত সমুদ্রের জল তার নিচের মাটি অপেক্ষা বেশি জোরে আকৃষ্ট হয়। এ কারণে চাঁদের দিকে অবস্থিত জল বেশি ফুলে উঠে। আবার পৃথিবীর যে অংশে অবস্থিত জল চাঁদের বিপরীত দিকে থাকে, সেদিকের সমুদ্রের নিচের মাটি তার উপরের জল অপেক্ষা চাঁদ কর্তৃক অধিক জোরে আকৃষ্ট হয়। কারণ এই মাটি জল অপেক্ষা চাঁদের বেশি নিকটবর্তী। ফলে সেখানকার জল মাটি থেকে দূরে সরে যায় অর্থাৎ ছাপিয়ে উঠে। এক্ষেত্রে ফুলে উঠার কাহিনীটিই ঘটে। পৃথিবী যে সময়ের মধ্যে নিজ অক্ষের চারদিকে একবার আবর্তন করে (এক দিনে) সে সময়ের মধ্যে পৃথিবীর যে-কোন অংশ একবার চাঁদের দিকে থাকে এবং একবার চাঁদের বিপরীত দিকে থাকে। এ কারণে পৃথিবীর যে-কোন স্থানে দুইবার জোয়ার এবং দুইবার ভাটা হয়।

তবে জোয়ার-ভাটার জন্য সূর্যের আকর্ষণও অনেকাংশে দায়ী। তবে অনেক দূরে থাকায় সূর্যের আকর্ষণ চাঁদের আকর্ষণের থেকে কম কার্যকর। সূর্য এবং চাঁদ যখন সমসূত্রে পৃথিবীর একই দিকে বা বিপরীত দিকে অবস্থান করে তখন উভয়ের আকর্ষণে সর্বাপেক্ষা উঁচু জোয়ার হয়, জোয়ারের জল বেশি ছাপিয়ে পড়ে। এই অবস্থাকে ভরা কাটাল বা উঁচু জোয়ার বলা হয়। আর পৃথিবীকে কেন্দ্র করে সূর্য এবং চাঁদের মধ্য কৌণিক দূরত্ব যখন এক সমকোণ পরিমাণ হয় তখন একের আকর্ষণ অন্যের আকর্ষণ দ্বারা প্রশমিত হয়। তাই সবচেয়ে নিচু জোয়ার হয় যাকে মরা কাটাল বলে আখ্যায়িত করা হয়। জোয়ার বলতে আমরা শুধুমাত্র সমুদ্রের জলের স্ফীতিকেই বুঝি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে চাঁদ-সূর্যের আকর্ষণে পৃথিবীর স্থলভাগেও অনুরূপ প্রভাবের সৃষ্টি হয়। তাই বলা যায়, জোয়ার -ভাটার ক্ষেত্রে চাঁদ ও সূর্য এবং এদের মধ্যকার আকর্ষণ বল ও অবস্থান মুখ্য ভুমিকা পালন করে।

দিনের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি

[সম্পাদনা]

চন্দ্রপৃষ্ঠ

[সম্পাদনা]

চাঁদের সৃষ্টির পরপর, এর পৃষ্ঠ অনেক গরম ছিল এবং কোনো প্রকার গর্ত ছিল না। চাঁদে বিপুল পরিমাণে ধূমকেতু ও গ্রহানুর আঘাতে গর্তের সৃষ্টি হয়। এই সময়টি late heavy bombardment নামে পরিচিত।

চাঁদের দুই পার্শ্ব

[সম্পাদনা]

চাঁদের ঘূর্ণনটি সঙ্কালিক অর্থাৎ ঘূর্ণনের সময় সবসময় চাঁদের একটি পৃষ্ঠই পৃথিবীর দিকে মুখ করা থাকে। চাঁদের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় এর ঘূর্ণন ধীরতর হতে হতে একটি নির্দিষ্ট গতিতে এসে locked হয়ে যায়। পৃথিবী দ্বারা সৃষ্ট জোয়ার-ভাটা সংক্রান্ত বিকৃতির সাথে সম্পর্কিত ঘর্ষণ ক্রিয়ার কারণেই এই লকিং সৃষ্টি হয়। উপরন্তু, চান্দ্র কক্ষপথের উৎকেন্দ্রিকতা থেকে যে ক্ষুদ্র পরিবর্তনের সৃষ্টি হয় তার কারণে পৃথিবী থেকে চন্দ্রপৃষ্ঠের শতকরা প্রায় ৫৯ ভাগ দৃশ্যমান হয়ে উঠে। এই পরিবর্তনের ক্রিয়াটিকে লাইব্রেশন বলা হয়।

চাঁদের নিকট পার্শ্ব
চাঁদের দূর পার্শ্ব

চাঁদের যে পৃষ্ঠটি পৃথিবীর দিকে মুখ করে থাকে তাকে নিকট পার্শ্ব বলা হয় এবং এর বিপরীত পৃষ্ঠটিকে বলা হয় দূর পার্শ্ব। দূর পার্শ্বের সাথে আবার অন্ধকারাচ্ছন্ন পার্শ্বের সাথে গুলিয়ে ফেলা ঠিক হবে না। চাঁদের যে গোলার্ধে কোনো নির্দিষ্ট সময়ে সূর্যের আলো পৌঁছায় না সে গোলার্ধকে অন্ধকারাচ্ছন্ন পার্শ্ব বলা হয়। ১৯৫৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের লুনা ৩ নামক নভোযান প্রথমবারের মতো চাঁদের দূর পার্শ্বের ছবি তুলেছিল। এই পার্শ্বের একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এখানে একেবারেই কোনো মারিয়া (চাঁদের বিশেষ ভূমিরূপ, আক্ষরিক অর্থে সাগর) নেই।

চাঁদের লাইব্রেশন

মারিয়া

[সম্পাদনা]

পূর্ণিমার সময় মানুষ পৃথিবী পৃষ্ঠ থেকে চাঁদের অপেক্ষাকৃত অন্ধকারাচ্ছন্ন এবং স্বতন্ত্র ধরনের যে পৃষ্ঠগুলো দেখতে পায় তাদেরকে বলা হয় মারিয়া (maria, একবচন – mare)। লাতিন ভাষায় মারে শব্দের অর্থ সাগর। প্রাচীনকালে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এই অংশগুলো পানি দ্বারা পূর্ণ বলে ভাবতেন বিধায়ই এ ধরনের নামকরণ করা হয়েছিল। পরবর্তীতে আর নামের পরিবর্তন করা হয়নি। সুপ্রাচীন ব্যাসল্ট দ্বারা গঠিত কঠিন লাভার পুকুর হিসেবে এগুলোকে আখ্যায়িত করা যায়। চাঁদের পৃষ্ঠের সাথে উল্কা এবং ধূমকেতুর সংঘর্ষের ফলে অনেক ইমপ্যাক্ট অববাহিকার সৃষ্টি হয়েছে। চাঁদের ব্যাসাল্টিক লাভার অধিকাংশ উৎক্ষিপ্ত হয়ে এই অববাহিকাগুলোর সাথে সম্পর্কিত নিম্নভূমির মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছিল। এক্ষেত্রে একমাত্র ব্যতিক্রম হল Oceanus Procellarum। কারণ এর সাথে কোন ইমপ্যাক্ট অববাহিকার সম্পর্ক নেই। মারিয়ার অধিকাংশ চাঁদের নিকট পার্শ্বে অবস্থিত।

জলের অস্তিত্ব

[সম্পাদনা]

১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দের অ্যাপোলো অভিযানে চাঁদ থেকে আনা পাথরখণ্ড পরীক্ষা করে বিজ্ঞানীরা প্রথম দাবি করেছিলেন যে, চাঁদে পানি রয়েছে। তারপর ভারত তাদের প্রথম চন্দ্রাভিযানের (চন্দ্রযান-১) পর একই দাবি করে। ভারতীয় বিজ্ঞানীরা চন্দ্রযান-১ ছাড়াও দুটো মার্কিন নভোযানের (ডিপ ইমপ্যাক্টক্যাসিনি) পাঠানো উপাত্ত বিশ্লেষণ নিশ্চিত হয়ে এমন দাবি উত্থাপন করেন। ভারতীয় নভোযানটি নাসা'র সরবরাহকৃত চন্দ্রপৃষ্ঠের ২-৩ ইঞ্চি গভীরে অনুসন্ধানক্ষম মুন মিনারেলজি ম্যাপার (এম৩) নামক একটি যন্ত্রের সহায়তায় চন্দ্রপৃষ্ঠের মেরু অঞ্চলে সূর্যের প্রতিফলিত আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য পরীক্ষা করে প্রমাণ পায় যে চাঁদের মাটির ১০,০০,০০০ কণায় পানির কণা হলো ১,০০০। গবেষণায় চন্দ্রপৃষ্ঠের পাথর ও মাটিতে প্রায় ৪৫% অক্সিজেনের প্রমাণ মিলেছে। তবে হাইড্রোজেনের পরিমাণ গবেষণাধীন রয়েছে (২০০৯)। অবশ্য গবেষণায় এও বলা হয় যে, চাঁদের মেরু অঞ্চলের নানা গর্তের তলদেশে বরফ থাকলেও চাঁদের অন্য অঞ্চল শুষ্ক।[]

মানুষের অস্তিত্ব

[সম্পাদনা]
চন্দ্রপৃষ্ঠে অ্যাপোলো ১৭ অভিযানের পর মানুষের কাজের অবশিষ্টাংশ

চাঁদে মানুষের ক্রিয়াকলাপের চিহ্নের পাশাপাশি কিছু স্থায়ী স্থাপনাও রয়েছে। যেমন মুন মিউজিয়াম আর্ট পিস, অ্যাপোলো ১১ শুভেচ্ছার বার্তা, লুনার ফলক, ফ্যালেন অ্যাস্ট্রোনট স্মৃতি এবং অন্যান্য নিদর্শন।

পতিত নভোচারী

অবকাঠামো

[সম্পাদনা]

বিভিন্ন এজেন্সি এবং কোম্পানি চাঁদে একটি দীর্ঘমেয়াদী মানব বসতি স্থাপন করার পরিকল্পনা করেছে। যেখানে আর্টেমিস প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে বর্তমানে সবচেয়ে উন্নত প্রকল্প হিসেবে রয়েছে চন্দ্র গেটওয়ে

২০২৪ সালের কল্পিত চন্দ্র গেটওয়ের মডেল

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. https://www.prothomalo.com/international/article/1605611/%E0%A6%9A%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A6%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A6%A8-%E0%A7%A8-%E0%A6%8F%E0%A6%B0-%E0%A6%B8%E0%A6%AB%E0%A6%B2-%E0%A6%89%E0%A7%8E%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%B7%E0%A7%87%E0%A6%AA%E0%A6%A3-%E0%A6%95%E0%A6%B0%E0%A6%B2-%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A6%A4
  2. "চাঁদের বুকে পানির প্রমাণ পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা"। দৈনিক প্রথম আলো (প্রিন্ট)। ঢাকা। ২৫ সেপ্টেম্বর ২০০৯। পৃষ্ঠা ২৪। 

বহিঃসংযোগ

[সম্পাদনা]