ক্যালসিয়াম
ক্যালশিয়াম হচ্ছে Ca প্রতীকযুক্ত একটি মৌলিক পদার্থ, যার পারমাণবিক সংখ্যা ২০। ক্যালসিয়াম একটি ক্ষারীয় ধাতব পদার্থ। এজন্য ক্যালসিয়াম বেশ সক্রিয় ধাতু, যা বায়ুর সংস্পর্শে আসার পরে গাঢ় অক্সাইড-নাইট্রাইড স্তর গঠন করে। এর গাঠনিক ও রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যগুলির অধিকাংশই মিলে যায় এর চেয়ে কিছু ভারি ও সদৃশ মৌল স্ট্রনশিয়াম এবং বেরিয়ামের সাথে। পরিমাণের দিক থেকে এটি পৃথিবীর ভূত্বকের উপাদানগুলোর ভেতরে পঞ্চম অবস্থানে আছে। একইসাথে প্রাচুর্যের দিক থেকে পৃথিবীতে প্রাপ্ত ধাতুসমূহের ভেতরে এটি তৃতীয় অবস্থানে আছে, অর্থাৎ লোহা এবং অ্যালুমিনিয়ামের পরই এর অবস্থান। পৃথিবীতে সর্বাধিক পরিমাণে পাওয়া যায় এমন ক্যালসিয়াম যৌগটি হলো ক্যালসিয়াম কার্বোনেট, যা চুনাপাথর নামে পরিচিত। এটি সমুদ্রে প্রাপ্ত জীবাশ্মের অবশিষ্টাংশে পাওয়া যায়, যে জীবাশ্মগুলো সৃষ্ট হয়েছিলো সমুদ্র সৃষ্টির প্রারম্ভিক সময়ে। এর পাশাপাশি জিপসাম, অ্যানহাইড্রাইট, ফ্লোরাইট এবং অ্যাপাটাইট ক্যালসিয়ামের উৎস। ক্যালসিয়াম নামটি লাতিন শব্দ Calx Lime থেকে এসেছে। তৎকালে চুনাপাথরকে উত্তপ্ত করলে এটি পাওয়া যেত।
উপস্থিতি | Dull gray, silver | |||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|
আদর্শ পারমাণবিক ভরAr°(Ca) | ||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
পর্যায় সারণিতে ক্যালসিয়াম | ||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
| ||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
পারমাণবিক সংখ্যা | ২০ | |||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
মৌলের শ্রেণী | মৃৎক্ষার ধাতু | |||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
গ্রুপ | গ্রুপ ২: মৃৎক্ষার ধাতু | |||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
পর্যায় | পর্যায় ৪ | |||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
ব্লক | এস-ব্লক | |||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
ইলেকট্রন বিন্যাস | [Ar] ৪s২ | |||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
প্রতিটি কক্ষপথে ইলেকট্রন সংখ্যা | 2, 8, 8, 2 | |||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
ভৌত বৈশিষ্ট্য | ||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
দশা | কঠিন | |||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
গলনাঙ্ক | 1115 কে (842 °সে, 1548 °ফা) | |||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
স্ফুটনাঙ্ক | 1757 K (1484 °সে, 2703 °ফা) | |||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
ঘনত্ব (ক.তা.-র কাছে) | 1.55 g·cm−৩ (০ °সে-এ, ১০১.৩২৫ kPa) | |||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
তরলের ঘনত্ব | m.p.: 1.378 g·cm−৩ | |||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
ফিউশনের এনথালপি | 8.54 kJ·mol−১ | |||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
বাষ্পীভবনের এনথালপি | 154.7 kJ·mol−১ | |||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
তাপ ধারকত্ব | 25.929 J·mol−১·K−১ | |||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
বাষ্প চাপ
| ||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
পারমাণবিক বৈশিষ্ট্য | ||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
জারণ অবস্থা | +2, +1[৩] strongly basic oxide | |||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
তড়িৎ-চুম্বকত্ব | 1.00 (পলিং স্কেল) | |||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
আয়নীকরণ বিভব | (আরও) | |||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
পারমাণবিক ব্যাসার্ধ | empirical: 197 pm | |||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
সমযোজী ব্যাসার্ধ | 176±10 pm | |||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
ভ্যান ডার ওয়ালস ব্যাসার্ধ | 231 pm | |||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
বিবিধ | ||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
কেলাসের গঠন | face-centered cubic (fcc) | |||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
শব্দের দ্রুতি | পাতলা রডে: 3810 m·s−১ (at 20 °সে) | |||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
তাপীয় প্রসারাঙ্ক | 22.3 µm·m−১·K−১ (২৫ °সে-এ) | |||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
তাপীয় পরিবাহিতা | 201 W·m−১·K−১ | |||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
তড়িৎ রোধকত্ব ও পরিবাহিতা | ২০ °সে-এ: 33.6 n Ω·m | |||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
চুম্বকত্ব | diamagnetic | |||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
ইয়ংয়ের গুণাঙ্ক | 20 GPa | |||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
কৃন্তন গুণাঙ্ক | 7.4 GPa | |||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
আয়তন গুণাঙ্ক | 17 GPa | |||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
পোয়াসোঁর অনুপাত | 0.31 | |||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
(মোজ) কাঠিন্য | 1.75 | |||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
ব্রিনেল কাঠিন্য | 167 MPa | |||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
ক্যাস নিবন্ধন সংখ্যা | 7440-70-2 | |||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
ক্যালসিয়ামের আইসোটোপ | ||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
| ||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
কিছু ক্যালসিয়াম যৌগ প্রাচীন মানুষদের কাছে পরিচিত ছিল, যদিও তাদের রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য সতেরো শতক পর্যন্ত অজানাই ছিল। ১৮০৮ সালে হামফ্রে ডেভি ক্যালসিয়ামের অক্সাইড যৌগের তড়িৎ বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিশুদ্ধ ক্যালসিয়ামকে প্রথমবারের মতো পৃথক করেন। তিনিই এই উপাদানটির নাম ক্যালসিয়াম রেখেছিলেন। ক্যালসিয়ামের যৌগগুলো বিভিন্ন শিল্পে ব্যাপভাবে ব্যবহৃত হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়: ঔষধ শিল্পে মানবদেহের পরিপূরক খাদ্য হিসেবে, কাগজ শিল্পে ব্লিচ হিসাবে, সিমেন্ট ও বৈদ্যুতিক ইনসুলেটররের উপাদান হিসাবে এবং সাবান তৈরিতে ক্যালসিয়াম দরকার হয়। অন্যদিকে, বিশুদ্ধ ক্যালসিয়ামেরও সীমিত কিছু ব্যবহার রয়েছে, কারণ এটি অত্যন্ত প্রতিক্রিয়াশীল। ইস্পাত তৈরিতে মিশ্রণকারী উপাদান হিসাবে সামান্য পরিমাণে ক্যালসিয়াম ব্যবহৃত হয়। আবার, গাড়ির ব্যাটারি তৈরিতেও ক্যালসিয়াম ও সীসার সংকর ব্যবহৃত হয়।
মানবদেহে পাওয়া যায় এমন উপাদানগুলোর মধ্যে, মৌলের দিক হতে ক্যালসিয়ামের অবস্থান পঞ্চম এবং ধাতুর দিক থেকে প্রথম। ক্যালসিয়াম আয়নসমূহ জীব এবং জীবকোষের শারীরবৃত্তীয় এবং জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়াগুলিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মানবদেহের হাড় গঠনে ক্যালসিয়ামের ভূমিকা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।বাজারে বিভিন্ন ক্যালসিয়াম জাতীয় ঔষধ পাওয়া যায়।
বৈশিষ্ট্য
সম্পাদনাশ্রেণিকরণ
সম্পাদনাক্যালসিয়াম হল একটি খুব নমনীয় রৌপ্য রঙের ধাতু। এই রঙকে কখনও কখনও ফ্যাকাশে হলুদও বলা হয়ে থাকে। ক্যালসিয়ামের সাথে পর্যায় সারণীতে একই গ্রুপে অবস্থানকারী স্ট্রন্টিয়াম, বেরিয়াম এবং রেডিয়াম ইত্যাদি ভারী ধাতুর অনেক মিল আছে। একটি ক্যালসিয়াম পরমাণুতে বিশটি ইলেকট্রন থাকে, যার ইলেকট্রন বিন্যাস [আর্গন]4s2। পর্যায় সারণীর গ্রুপ-২ এর অন্যান্য মৌলের মতো ক্যালসিয়ামের বাহ্যিকতম এস-অর্বিটালে দুটি ফাঁকা ইলেকট্রন রয়েছে, যা খুব সহজেই রাসায়নিক বিক্রিয়ার সময় পূর্ণ হয় এবং তখন ক্যালসিয়াম আয়ন আর্গনের ইলেকট্রন বিন্যাস লাভ করে স্থিতিশীলতা অর্জন করে।[৫]
ক্যালসিয়াম, স্ট্রন্টিয়াম, বেরিয়াম এবং রেডিয়াম হচ্ছে মৃৎক্ষার ধাতু। পর্যায় সারণীর গ্রুপ ২-এর অন্যান্য সদস্য বেরিলিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়াম কিছুটা হালকা ভরের হলেও এদেরকেও একসাথেই অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তারপরও বেরিলিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়াম তাদের ভৌত এবং রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়ে গ্রুপের অন্যান্য সদস্যদের চেয়ে আলাদা।[৬]
ভৌত বৈশিষ্ট্য
সম্পাদনাক্যালসিয়াম ধাতুটি ৮৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় গলে যায় এবং ১৪৯৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় বাষ্পীভূত হয়। এই মানগুলো নিকটবর্তী ম্যাগনেসিয়াম এবং স্ট্রন্টিয়ামের চেয়ে বেশি। এটির স্ফটিক স্ট্রন্টিয়ামের মতো, মুখকেন্দ্রিক ঘনক বিন্যাসে বিন্যস্ত। এর ঘনত্ব ১.৫৫ গ্রাম / ঘনসেন্টিমিটার, যা নিজ গ্রুপের মাঝে সবচেয়ে কম।[৫] ক্যালসিয়াম সীসার চেয়ে শক্ত, তবে একটু জোর খাটালে ছুরি দিয়ে কাটা যায়। স্বল্প ঘনত্বের কারণে বিদ্যুৎ পরিবাহক হিসেবে এটি তামা বা অ্যালুমিনিয়ামের তুলনায় কম শক্তিশালী।[৭]
রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য
সম্পাদনাক্যালসিয়ামের একটি ভারী ক্ষারীয় ধাতু। উদাহরণস্বরূপ, ক্যালসিয়াম স্বতঃস্ফূর্তভাবে পানির সাথে ম্যাগনেসিয়ামের চেয়ে দ্রুত এবং ক্যালসিয়াম হাইড্রোক্সাইড ও হাইড্রোজেন গ্যাস উৎপাদনের ক্ষেত্রে স্ট্রন্টিয়ামের চেয়ে কম দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখায়। এটি বাতাসে অক্সিজেন ও নাইট্রোজেনের সাথে যথাক্রমে ক্যালসিয়াম অক্সাইড ও ক্যালসিয়াম নাইট্রাইডের মিশ্রণ তৈরি করে। বায়ুর আপেক্ষিক আর্দ্রতা ৩০% এর চেয়ে কম হলে ক্যালসিয়ামকে অনির্দিষ্টকালের জন্য কক্ষ তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা যেতে পারে।[৭]
ক্যালসিয়াম অক্সাইড বা CaO হচ্ছে ক্যালসিয়ামের সাধারণ একটি অক্সাইড। এছাড়া অক্সিজেনের উচ্চ চাপে ক্যালসিয়ামকে অক্সিডাইজ করলে ক্যালসিয়াম পারঅক্সাইড বা CaO2 পাওয়া যায়। ক্যালসিয়াম হাইড্রক্সাইড বা Ca(OH)2 একটি অত্যন্ত শক্তিশালী ক্ষারক। ক্যালসিয়ামের প্রধান খনিজ ক্যালসিয়াম কার্বোনেট (CaCO3) ও ক্যালসিয়াম সালফেট (CaSO4)। পৃথিবীতে এগুলোই ক্যালসিয়ামের প্রধান উৎস।[৫]
Ca2+ আয়নের আকার বেশ বড়। ক্যালসিয়াম সহজেই ইডিটিএ এবং পলিফসফেটের মতো অক্সিজেন চিলেটের সাথে যুক্ত হয়, যার মাধ্যমে কঠিন পানি থেকে ক্যালসিয়াম আয়নগুলোকে পৃথক করা যায়।[৫]
আইসোটোপ
সম্পাদনাপ্রকৃতিতে ক্যালসিয়ামের পাঁচটি স্থিতিশীল আইসোটোপ রয়েছে। এগুলো হলো ৪০Ca, ৪২Ca, ৪৩Ca, ৪৪Ca ও ৪৬Ca। আরও একটি আইসোটোপ রয়েছে (৪৮Ca), যেটি অস্তিতিশীল হলেও এর অর্ধায়ু এতটাই বেশি (প্রায় ৪.৩ × ১০১৯ বছর) যে এটিকেও স্থিতিশীল হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে।[৮]
প্রকৃতিতে ক্যালসিয়ামের যে আইসোটোপটি সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় তা হচ্ছে ৪০Ca, যা মোট প্রাকৃতিক ক্যালসিয়ামের ৯৬.৯৪১%। এটি সিলিকন পোড়ানোর মাধ্যমে আলফা কণার ফিউশন দ্বারা উৎপাদিত হয়। ক্যালসিয়ামের অন্য চারটি আইসোটোপ, অর্থাৎ ৪২Ca, ৪৩Ca, ৪৬Ca ও ৪৮Ca প্রকৃতিতে খুবই কম পরিমাণে থাকে, সব মিলিয়ে মাত্র এক শতাংশের মতো। এই চারটি আইসোটোপ তুলনামূলকভাবে হালকা, যেগুলো পাওয়া যায় অক্সিজেন এবং সিলিকন পোড়ানোর মাধ্যমে।[৯]
ইতিহাস
সম্পাদনামানবসভ্যতায় ক্যালসিয়ামের বিভিন্ন যৌগের ব্যবহার প্রায় লক্ষাধিক বছরের, যদিও ১৭ শতকের আগে এটির রাসায়নিক গঠন বা আচরণ উন্মোচিত হয়নি।[৫] দালানকোঠার উপাদান হিসাবে এবং মূর্তির প্লাস্টার হিসাবে প্রায় ৭০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দেও চুনের ব্যবহার ছিলো[১০]। প্রায় একই সময়কালে, গিজার বিখ্যাত খুফু'র পিরামিডে শুষ্ক সাজিমাটি (CaSO4 · 2H2O) ব্যবহৃত হয়েছে। একই উপাদান পরে তুতানখামেনের সমাধিতে প্লাস্টারের জন্যও ব্যবহৃত হয়েছে। প্রাচীনকালে রোমানরা চুনাপাথর (CaCO3) উত্তপ্ত করে পাওয়া চুনের মশলা বা সিমেন্ট নির্মাণকাজে ব্যবহার করতো।
১৭৮৭ সালে ফরাসি বিজ্ঞানী অঁতোয়ান লাভোয়াজিয়ে সন্দেহ করেছিলেন যে, চুন কোনও একটি মৌলিক রাসায়নিক উপাদানের অক্সাইড হতে পারে।
ক্যালসিয়ামকে প্রথম পৃথক করেন হামফ্রে ডেভি, ১৮০৮ সালে। ডেভি এটি করেন তড়িৎ বিশ্লেষণের মাধ্যমে। তিনি ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়ামের ধাতব অক্সাইড এবং পারদ (II) অক্সাইডের মিশ্রণকে প্লাটিনামের প্লেটে স্থাপন করেন এবং এটিকে অ্যানোড হিসেবে ব্যবহার করেন। অন্যদিকে ক্যাথোডরূপে ব্যবহৃত হয় পারদে কিছুটা ডোবানো প্লাটিনামের তার। তড়িৎ বিশ্লেষণের মাধ্যমে ক্যালসিয়াম–পারদ এবং ম্যাগনেসিয়াম–পারদের মিশ্রণ পাওয়া যায়। এরপর পারদ অপসারিত করে ক্যালসিয়াম পাওয়া যায়।[৫][১১] তবে এই পদ্ধতিতে বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য পর্যাপ্ত ক্যালসিয়াম পরিমাণে প্রস্তুত করা যায় না, কারণ এতে খুবই অল্প ক্যালসিয়াম পাওয়া যায়। এর প্রায় এক শতাব্দীরও বেশি সময় পরে ক্যালসিয়াম উৎপাদনের জন্য কার্যকর বাণিজ্যিক প্রক্রিয়া উদ্ভাবিত হয়েছে।[১২]
উৎপাদন
সম্পাদনাক্যালসিয়াম পৃথিবীর ভূত্বকের উপাদানগুলোর মধ্যে পরিমাণের দিক থেকে পঞ্চম সাথেন আছে। ধাতুর দিক থেকে পৃথিবীপৃষ্ঠে অ্যালুমিনিয়াম এবং লোহার পর ক্যালসিয়ামই তৃতীয় সর্বাধিক ধাতু।[৫] এছাড়া চাঁদের উচ্চশ্রেণির পর্বতগুলোতেও এটি চতুর্থ সর্বাধিক উপাদান।[৭] ক্যালসিয়ামের খনিজগুলির মধ্যে চুনাপাথর, ডলোমাইট, মার্বেল, চকখড়ি উল্লেখযোগ্য। প্রবাল, শামুক-ঝিনুকের খোসা এবং মুক্তো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ক্যালসিয়াম কার্বোনেট দিয়ে তৈরি। ক্যালসিয়ামের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ খনিজগুলির মধ্যে আছে সাজিমাটি বা জিপসাম (CaSO4·2H2O), অ্যানহাইড্রাইট (CaSO4), ফ্লুরাইট (CaF2), এবং অ্যাপাটাইট ([Ca5(PO4)3F])।
ক্যালসিয়ামের প্রধান উৎপাদক চীন, (বছরে প্রায় ১০,০০০ থেকে ১২,০০০ টন), রাশিয়া (প্রতি বছর প্রায় ৬,০০০ থেকে ৮,০০০ টন) এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (বছরে প্রায় ২,০০০ থেকে ৪,০০০ টন)। কানাডা এবং ফ্রান্সও অল্প পরিমাণে উৎপাদন করে থাকে। ২০০৫ সালে বিশ্বে প্রায় ২৪,০০০ টন ক্যালসিয়াম উৎপাদিত হয়েছিল। বিশ্বের মোট উত্তোলিত ক্যালসিয়ামের প্রায় অর্ধেকই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্যবহার করে থাকে।[৭]
ব্যবহার
সম্পাদনাধাতব ক্যালসিয়াম সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয় ইস্পাত তৈরিতে। গাড়ির যেসব ব্যাটারির রক্ষণাবেক্ষণ করতে হয় না, এধরনের ব্যাটারিগুলিতেও ক্যালসিয়াম ব্যবহৃত হয়। এটি ক্রোমিয়াম, জিরকনিয়াম, থোরিয়াম এবং ইউরেনিয়াম উৎপাদনে হ্রাসকারী এজেন্ট হিসাবেও ব্যবহৃত হয়। এটি হাইড্রোজেন গ্যাস সংরক্ষণ করার জন্যও ব্যবহার করা যায়, কারণ এটি হাইড্রোজেনের সাথে বিক্রিয়া করে শক্ত ক্যালসিয়াম হাইড্রাইড তৈরি করে, যা থেকে হাইড্রোজেন সহজেই আবার আলাদা করা যায়।
ক্যালসিয়ামের প্রচুর যৌগ ব্যবহৃত হয় খাদ্য ও ঔষধ হিসাবে। উদাহরণস্বরূপ: খাবারে ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস পরিপূরক হিসেবে প্রদান করা হয়; এর সাথে ক্যালসিয়াম ল্যাকটেট, ক্যালসিয়াম ডিফোসফেট এবং ট্রাইসিলিয়াম ফসফেট যুক্ত করা হয়। এছাড়া বেকিংয়ের কাজে ক্যালসিয়াম মনোফসফেট খামির তৈরির এজেন্ট হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ক্যালসিয়াম সালফাইট কাগজ তৈরিতে ব্লিচ হিসাবে এবং একটি উত্তম জীবাণুনাশক হিসেবে ব্যবহৃত হয় ইত্যাদি।
ক্যালসিয়াম মানবদেহের জন্যও একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। পেশিজ কার্যক্রম সচল রাখা, রক্তসঞ্চালন, খাদ্য হজম প্রক্রিয়া এবং বিশেষ করে হাড়ের গঠনে ক্যালসিয়ামের অনবদ্য ভূমিকা রয়েছে। বিভিন্ন স্বাস্থ্য সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান নিয়মিতভাবে পর্যাপ্ত ক্যালসিয়াম গ্রহণের ওপর গুরুত্বারোপ করেছে। আমেরিকান মেডিসিন ইনস্টিটিউট (আইওএম) এবং ইউরোপীয় খাদ্য নিরাপত্তা সংস্থা (ইএফএসএ) ক্যালসিয়াম গ্রহণের মাত্রা নির্ধারণ করেছে। আইওএম-এর মতে, ৯-১৮ বছর বয়সীদের দৈনিক ক্যালসিয়াম গ্রহণের হার সর্বোচ্চ হতে পারে ৩ গ্রাম, ১৯-৫০ বছর বয়সীদের দৈনিক ২.৫ গ্রাম, ৫১ ও তদূর্ধ্বদের জন্য দৈনিক ২ গ্রামের বেশি নয়। আর ইএফএসএ সকল প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য মাত্রা নির্ধারণ করেছে ২.৫ গ্রাম/দিন। তারা অবশ্য শিশু-কিশোরদের জন্য কোনো মাত্রা নির্ধারণ করেনি।
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ "Standard Atomic Weights: ক্যালসিয়াম"। CIAAW। ১৯৮৩।
- ↑ Prohaska, Thomas; Irrgeher, Johanna; Benefield, Jacqueline; Böhlke, John K.; Chesson, Lesley A.; Coplen, Tyler B.; Ding, Tiping; Dunn, Philip J. H.; Gröning, Manfred; Holden, Norman E.; Meijer, Harro A. J. (২০২২-০৫-০৪)। "Standard atomic weights of the elements 2021 (IUPAC Technical Report)"। Pure and Applied Chemistry (ইংরেজি ভাষায়)। আইএসএসএন 1365-3075। ডিওআই:10.1515/pac-2019-0603।
- ↑ Krieck, Sven; Görls, Helmar; Westerhausen, Matthias (২০১০)। "Mechanistic Elucidation of the Formation of the Inverse Ca(I) Sandwich Complex [(thf)3Ca(μ-C6H3-1,3,5-Ph3)Ca(thf)3] and Stability of Aryl-Substituted Phenylcalcium Complexes"। Journal of the American Chemical Society। 132 (35): 100818110534020। ডিওআই:10.1021/ja105534w। পিএমআইডি 20718434।
- ↑ কনদেব, এফ.জি.; ওয়াং, এম.; হুয়াং, ডব্লিউ.জে.; নাইমি, এস.; আউডি, জি. (২০২১)। "The NUBASE2020 evaluation of nuclear properties" [পারমাণবিক বৈশিষ্ট্যের নুবেস২০২০ মূল্যায়ন] (পিডিএফ)। চাইনিজ ফিজিক্স সি (ইংরেজি ভাষায়)। ৪৫ (৩): ০৩০০০১। ডিওআই:10.1088/1674-1137/abddae।
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ চ ছ GREENWOOD, N.N.; EARNSHAW, A. (১৯৮৪)। Chemistry of the Elements। Elsevier। পৃষ্ঠা v–vi। আইএসবিএন 9780080307121।
- ↑ Parish, R. V. (Richard Vernon), 1934- (১৯৭৭)। The metallic elements। London: Longman। আইএসবিএন 0582442788। ওসিএলসি 2597394।
- ↑ ক খ গ ঘ Hluchan, Stephen E.; Pomerantz, Kenneth (২০০০-০৬-১৫)। "Calcium and Calcium Alloys"। Ullmann's Encyclopedia of Industrial Chemistry। Weinheim, Germany: Wiley-VCH Verlag GmbH & Co. KGaA। আইএসবিএন 3527306730।
- ↑ CRC handbook of chemistry and physics। Lide, David R., 1928- (86th ed., 2005-2006 সংস্করণ)। Boca Raton: CRC Press। ২০০৫। আইএসবিএন 0849304865। ওসিএলসি 61108810।
- ↑ Cameron, A. G. W. (১৯৭৩-০৯-০১)। "Abundances of the elements in the solar system"। Space Science Reviews (ইংরেজি ভাষায়)। 15 (1): 121–146। আইএসএসএন 1572-9672। ডিওআই:10.1007/BF00172440।
- ↑ Garfinkel, Y. (১৯৮৭)। "Burnt Lime Products and Social Implications in the Pre-Pottery Neolithic B Villages of the Near East"। Paléorient। 13 (1): 69–76। ডিওআই:10.3406/paleo.1987.4417।
- ↑ Davy Humphry (১৮০৮-০১-০১)। "XXIII. Electro-chemical researches, on the decomposition of the earths; with observations on the metals obtained from the alkaline earths, and on the amalgam procured from ammonia"। Philosophical Transactions of the Royal Society of London। 98: 333–370। ডিওআই:10.1098/rstl.1808.0023।
- ↑ Weeks, Mary Elvira। The discovery of the elements। Whitefish, Mont: Kessinger Pub। আইএসবিএন 0766138720। ওসিএলসি 71322678।