করম পরব
করম পরব ভারতের ঝাড়খণ্ড, বিহার, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, আসাম, ওড়িশা এবং পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য এবং বাংলাদেশ ও নেপালে পালিত একটি ফসল কাটার উৎসব। এই উৎসবে করম দেবতার উপাসনা করা হয়। যিনি শক্তি, যুব ও যৌবনের দেবতা।[১][২] করম পরব ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের পুরুলিয়া জেলা,ঝাড়গ্রাম জেলা,বাঁকুড়া জেলা,পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা-র কুড়মি, ভূমিজ, রাজপুত, সরাক, লোহার, বাউরি, বীরহড়, বীরনিয়া, খেরওয়ার, হো, খেড়িয়া, শবর, কোড়া, মাহালি, পাহাড়িয়া, হাড়ি, বাগদি, বেদে, ঘাসি, লোধা ও বৃহৎ জনগোষ্ঠী সাঁওতাল, মুন্ডা, ওঁরাও প্রভৃতি সম্প্রদায়ের আরণ্যক ও কৃষিভিত্তিক লোকউৎসব।
পালনরীতি
[সম্পাদনা]প্রতি বছর ভাদ্র মাসের শুক্ল একাদশী তিথিতে করম পরব উৎসব হয়ে থাকে। এর সাতদিন আগে মেয়েরা ভোরবেলায় শালের দাঁতন কাঠি ভেঙে নদী বা পুকুরে স্নান করে বাঁশ দিয়ে বোনা ছোট টুপা ও ডালায় বালি দিয়ে ভর্তি করেন। তারপর গ্রামের প্রান্তে একস্থানে ডালাগুলিকে রেখে জাওয়া গান গাইতে গাইতে তিন পাক ঘোরে। এরপর তাতে তেল ও হলুদ দিয়ে মটর, মুগ, বুট, জুনার ও কুত্থির বীজ মাখানো হয়। অবিবাহিত মেয়েরা স্নান করে ভিজে কাপড়ে ছোট শাল পাতার থালায় বীজগুলিকে বুনা দেন ও তাতে সিঁদুর ও কাজলের তিনটি দাগ টানা হয়, যাকে বাগাল জাওয়া বলা হয়। এরপর ডালাতে ও টুপাতে বীজ বোনা হয়। এরপর প্রত্যেকের জাওয়া চিহ্নিত করার জন্য কাশকাঠি পুঁতে দেওয়া হয়। একে জাওয়া পাতা বলা হয়। যে ডালায় একাধিক বীজ পোঁতা হয়, তাকে সাঙ্গী জাওয়া ডালা এবং যে ডালায় একটি বীজ পোঁতা হয়, তাকে একাঙ্গী জাওয়া ডালা বলা হয়। যে সমস্ত কুমারী মেয়েরা এই কাজ করেন, তাদের জাওয়ার মা বলা হয়। বাগাল জাওয়াগুলিকে লুকিয়ে রেখে টুপা ও ডালার জাওয়াগুলিকে নিয়ে তারা গ্রামে ফিরে আসেন। দিনের স্নান সেরে পাঁচটি ঝিঙাপাতা উলটো করে বিছিয়ে প্রতি পাতায় একটি দাঁতনকাঠি রাখা হয়। পরদিন গোবর দিয়ে পরিষ্কার করে আলপনা দেওয়া হয় ও দেওয়ালে সিঁদুরের দাগ দিয়ে কাজলের ফোঁটা দেওয়া হয়। পুরুষেরা শাল গাছের ডাল বা ছাতাডাল সংগ্রহ করে আনেন। গ্রামের বয়স্কদের একটি নির্দিষ্ট করা স্থানে দুইটি করম ডাল এনে পুঁতে রাখা হয়, যা সন্ধ্যার পরে করম ঠাকুর বা করম গোঁলায় এবং ধরম ঠাকুর হিসেবে পূজিত হন। কুমারী মেয়েরা সারাদিন উপোষ করে সন্ধ্যার পরে থালায় ফুল, ফল সহকারে নৈবেদ্য সাজিয়ে এই স্থানে গিয়ে পূজা করেন। এরপর সারারাত ধরে নাচ গান চলে। পরদিন সকালে মেয়েরা জাওয়া থেকে অঙ্কুরিত বীজগুলিকে উপড়ে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিয়ে বাড়িতে বিভিন্ন স্থানে সেগুলিকে ছড়িয়ে দেন। এরপর করম ডালটিকে জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়।[৩]:২৫৫-২৫৭[৪]:৬৩,৬৪ পূজার পরে মেয়েরা পরস্পরকে করমডোর বা রাখী পরিয়ে দেয়। এই করমসখীরা, কর্মস্থলে একে অপরকে রক্ষা করে। জঙ্গলে পাখির ডাকের নকলে ‘করমড্যের’ ডেকে বিপদ জানায়।
করম নাচ
[সম্পাদনা]করম উৎসবের সময় সমস্ত রাত ধরে সুর্যোদয় পর্যন্ত সম্মিলিত ভাবে ভাদরিয়া ঝুমুর গান ও যৌথ নাচ পরিবেশিত হয়। এই নাচে শুধুমাত্র অবিবাহিত ও প্রথম বছরের নববিবাহিতা মেয়েরাই অংশ গ্রহণ করতে পারেন। নৃত্যশিল্পীরা অর্ধবৃত্তাকারে হাত ধরাধরি করে এক পা এগিয়ে পিছিয়ে জাওয়া ডালিগুলিকে কেন্দ্র করে বৃত্তাকারে ঘড়ির কাটার বিপরীত দিকে ঘুরে ঘুরে নৃত্য করেন। একজন উচ্চস্বরে গান শুরু করার পরে নৃত্যশিল্পীরা গান শুরু করে ধীরে ধীরে গানের সুর নামিয়ে আনেন। একই কথা বারে বারে গাওয়া হয়।[৪]:৬৩,৬৪ মেয়েদের পড়নে লুঙ্গি, গামছা কিংবা শাড়ি; রূপার গহনা ও মাথায় ফুল। করম নাচে গৃহকাজ কৃষিকাজ ফুটিয়ে তোলা হয়।
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ "Wangala, Tusu, Karma: 8 lesser-known harvest festivals"। m.telegraphindia.com।
- ↑ "Karam festival shows to way to humanity: Harivansh"। www.avenuemail.in। ৩০ এপ্রিল ২০১৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৫ ডিসেম্বর ২০২০।
- ↑ তরুণদেব ভট্টাচার্য, পুরুলিয়া,ফার্মা কে এল প্রাইভেট লিমিটেড, ২৫৭-বি, বিপিন বিহারী গাঙ্গুলী স্ট্রিট, কলকাতা-১২, ২০০৯
- ↑ ক খ দিলীপ কুমার গোস্বামী, সীমান্ত রাঢ়ের লোকসংস্কৃতি, প্রকাশক- পারিজাত প্রকাশনী, বিদ্যাসাগর পল্লী, পুরুলিয়া-৭২৩১০১, প্রথম প্রকাশ- ২৪শে ডিসেম্বর, ২০১৪