বর্গভীমা মন্দির
দেবী বর্গভীমা | |
---|---|
ধর্ম | |
অন্তর্ভুক্তি | হিন্দুধর্ম |
জেলা | পূর্ব মেদিনীপুর |
অবস্থান | |
অবস্থান | তমলুক |
দেশ | ভারত |
স্থাপত্য | |
ধরন | বাংলা |
সৃষ্টিকারী | মাহিষ্যরাজ তাম্রধ্বজ |
বর্গভীমা বা ভীমরূপা মাতা বঙ্গদেশের পৌরাণিক তাম্রলিপ্ত জনপদের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। তিনি হলেন কালী মতান্তরে উগ্রতারা। তিনি পশ্চিমবঙ্গের তথা প্রাচীন বঙ্গদেশের ঐতিহাসিক বন্দরশহর তাম্রলিপ্ত শহরের প্রাণকেন্দ্রে প্রতিষ্ঠিত রয়েছেন। অনুমান করা হয়, পৌরাণিক তাম্রলিপ্ত জনপদ প্রতিষ্ঠার পূর্ব থেকেই তাঁর মন্দির এই স্থানে প্রতিষ্ঠিত। ভারতের অন্যতম জাগ্রত ও প্রধান শক্তিপীঠ।[১] পীঠ নির্ণায়ক তত্ত্ব অনুযায়ী এটি ৫১ পীঠের প্রথম পীঠ। যা প্রাচীন ধ্রুপদী বাংলা মাতৃকা উপাসনা ও শক্তি আরাধনার চিহ্ন বহন করছে।[২][৩][৪] শাক্ত ঐতিহ্যের কারণে মেদিনীপুর জেলার অনেক বিপ্লবী এখানে শপথ নিয়েছিলেন যে তারা ধর্মের পথে চলবেন এবং সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে মাতৃভূমিকে পরাধীনতা থেকে মুক্ত করবেন। ভারতের বিখ্যাত বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসু এখানে পূজা করতে আসতেন। স্থানীয় লোকেরা এই মন্দিরে দুর্গাপূজা, বাংলা নববর্ষ এবং কালী পূজা উপলক্ষে বিশাল উৎসব উদ্যাপন করে। এই মন্দিরে প্রসাদ দেবীর জন্য প্রতিদিন প্রস্তুত হয় এবং বেশিরভাগ শক্তি মন্দিরের মতো দেবীর প্রসাদও নিরামিষ হয় না। দেবীর প্রসাদ হিসেবে এখানে শোল মাছ রান্না বাধ্যতামূলক। বলির আচারটি এখন বাতিল করা হলেও বছরে একবারে এখনও তা হয়।[৫]
ইতিহাস
[সম্পাদনা]ঐতিহাসিকদের মতে এই মন্দিরটি একটি বৌদ্ধসংঘ।[৬] পূর্ব ভারতের হিন্দুধর্মের পুনরুত্থানে বঙ্গদেশের শক্তির আরাধকদের পৃষ্ঠপোষকতায় এটি হিন্দু মন্দিরে রূপান্তরিত হয়েছে। সেই হিসাবে এই মন্দির সেন যুগ বল্লাল সেন আমলে তৈরী হয়। ব্রহ্মপুরাণ হিসাবে আগে বর্গভীমার জন্য তাম্রলিপ্ত একটি বিশিষ্ট সিদ্ধপীঠ হিসেবে প্রকীর্তিত ছিল। পুরাকালে দেবাদিদেব মহাদেব দক্ষযজ্ঞে ব্রহ্মার পুত্র দক্ষ প্রজাপতিকে নিহত করলে ব্রহ্মহত্যার ফলস্বরূপ শরীর বিশ্লিষ্ট দক্ষের মাথা মহাদেবের হাতে সংসৃষ্ট হয়। মহাদেব কোনোপ্রকারেই একে নিজের হাত থেকে বিচ্ছিন্ন না করতে পেরে উদ্দাম নৃত্য করতে থাকেন, তাতেও হাত থেকে বিচ্ছিন্ন করতে না পেরে পৃথিবীর বিভিন্ন তীর্থে পরিভ্রমণ করতে থাকেন। কিন্তু, দক্ষের মাথা তাঁর হাত থেকে কিছুতেই বিশ্লিষ্ট না হওয়ায় তিনি বাধ্য হয়ে বিষ্ণুর নিকটে উপস্থিত হলেন। তখন বিষ্ণু বললেন :
“ | অহং তে কথয়িষ্যামি যত্র নশ্যতি পাতকং তত্র গত্বা ক্ষণামুক্তঃ পাপাদ্ধর্গো ভবিষ্যসি।। |
” |
অর্থাৎ,"সেখানে গমন করলে জীব ক্ষণকাল মধ্যে পাপ থেকে মুক্ত হয়, এবং সকল পাপ বিনষ্ট হয়, তোমায় সে স্থানের মাহাত্ম্য বলব।" এই বলে বিষ্ণু বললেন :
“ | আস্তি ভারতবর্ষস্য দক্ষিণস্যাং মহাপুরী, তমোলিপ্তং সমাখ্যাতং গূঢ়ঃ তীর্থ বরং বসেত্। |
” |
অর্থাৎ "ভারতবর্ষের দক্ষিণে তমোলিপ্ত (তাম্রলিপ্ত) নামে মহাতীর্থ আছে, তাতে গূঢ়তীর্থ বাস করে। সেখানে স্নান করলে লোকে বৈকুন্ঠে গমন করে। অতএব আপনি তীর্থরাজের দর্শনের জন্য সেখানে যান।" মহাদেব একথা শুনে তাম্রলিপ্ত হয়ে বর্গভীমা ও বিষ্ণু নারায়ণের মন্দির দুটির মধ্যবর্তী সরসীনীরে অবগাহন করলে দক্ষ-শির তাঁর হাত থেকে মুক্ত হল।
পৌরাণিক উপাখ্যান
[সম্পাদনা]মহাভারতের যুগে নরপতি মাহিষ্যরাজ তাম্রধ্বজ এক ধীবরপত্নীর কাছ থেকে শোনেন এক অলৌকিক কাহিনী। সে রোজ মরা মাছ কয়েক যোজন দূর থেকে এনে বনের ভেতর এক মন্দিরের পুকুরে ডুবিয়ে মাছকে জ্যান্ত করে নেয়। তারপর নিয়ে যায় রাজবাটীতে। রাজা তাম্রধ্বজ সেই কাহিনী শুনে ধীবরী সমভিব্যবহারে গিয়ে উপস্থিত হলেন বনের ভেতরের সেই মন্দিরে এবং প্রস্তরময়ী দেবীকে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠা করলেন।
কালাপাহাড় ও দেবী বর্গভীমা
[সম্পাদনা]ইতিহাসের দলিল ও প্রচলিত জনশ্রুতি অনুযায়ী, বঙ্গদেশের হিন্দু যখন কালাপাহাড়ের ভয়ানক ধংসলীলার সম্মুখিন, ঠিক তখন কালাপাহাড়ের মত ভয়ানক হিন্দুবিদ্বেষী মূর্তি ও মন্দিরনাশকের নাশকতাও থেমে গিয়েছিল এই মায়ের মন্দিরে এসে। বর্তমান দেবীর উপাসক মহাশয়দিগের নিকট একখন্ড পারসিক ভাষায় লিখিত দলিল রয়েছে, যেটা ‘বাদশাহী পঞ্জ’ বলে খ্যাত। ১৫৬৭-৬৮ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ দুরন্ত কালাপাহাড় উড়িষ্যা বিজয়ের পর বঙ্গদেশের তাম্রলিপ্তে প্রবেশ করেছেন, তিনি এই দেবীকে দর্শন করে শক্তিহীন হয়ে পড়েন এবং এই ঐতিহাসিক দলিল রচনা করেন। কিংবদন্তি মেশা কাহিনী বিস্ময়কর, লোমহর্ষক। কালাপাহাড় সুলেমান করণানির সেনাপতি ছিলেন।উড়িষ্যা অভিযান কালে কালাপাহাড় মন্দির ও দেবদেউল ধ্বংস করে বঙ্গদেশে এগিয়ে চলেছেন রূপনারায়ণের দিকে। তটে শিবির খাঁটিয়ে বর্গভীমার মন্দিরের দিকে একা এগিয়ে চললেন কালাপাহাড়। মন্দিরের দেবীগৃহের দুয়ারে এসে দাঁড়ালেন কালাপাহাড়। তারপর মন্দির ধ্বংস করে,তাঁবুতে না ফেরায় তাঁবুর পাঠান সৈনিকরা স্তম্ভিত হন। তাঁরা মন্দিরে এসে দেখেন দেবী বর্গভীমার পদতলে আশ্রয় নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন সুলেমান করণানির সেনাপতি কালাপাহাড়। মূর্তিনাশক কালাপাহাড় জীবনে প্রথম ও একমাত্র মূর্তিকে ধ্বংস করতে এসেও ধ্বংস করতে পারেন নি, সেই মূর্তি আজও তমলুকের মন্দিরে আরতির আলোকে প্রতি সন্ধ্যায় দীপ্ত হয়ে ওঠে।কালাপাহাড় সম্ভবত জালাল সাহের সময় ১২৬০-এর দিকে বর্তমান ছিলেন।
বৌদ্ধমন্দির
[সম্পাদনা]রাজেন্দ্রলাল গুপ্ত একটি প্রবন্ধে (সুরেশচন্দ্র সমাজপতি সম্পাদিত ‘সাহিত্য’ পত্রিকায়) লিখেছেন, ‘বর্গভীমা মন্দির পূর্বে বৌদ্ধমন্দির ছিল।’ এখনও মূল মন্দিরের চারদিকে অনেকগুলি ছোট ছোট গৃহ বা বিহার দেখা যায়। কালের আমোঘ নিয়মে তার অনেকগুলি ধ্বংস হলেও দুএকটি এখনও টিকে আছে। বর্তমান মন্দিরটিতে সম্ভবত প্রধান আচার্য থাকতেন। মন্দিরের গঠন অনেকটা বুদ্ধগয়ার মন্দিরের মতো।
বৌদ্ধ ও হিন্দুতন্ত্রের দেবী উগ্রতারা
[সম্পাদনা]দেবী বর্গভীমাকে অনেকে চণ্ডীতন্ত্রে কথিত ভীমাদেবী বলে মনে করেন। ৫১ পীঠের মধ্যে তমলুকের বর্গভীমাও একটি পীঠস্থান - দেবী কপালিনী(ভীমরূপা) ও ভৈরব সর্বানন্দ।
এই দেবীর মূর্তি একটি প্রস্তরের সম্মুখভাগ খোদাই করে নির্মাণ করা হয়েছে। এই মূর্তির গঠন উগ্রতারা মূর্তির মতই। প্রতিকৃতিটি কালো পাথরে খোদাই করা। এরকম খোদাই করা মূর্তি সচরাচর দেখা যায় না। এই দেবীর ধ্যান ও পূজাদি যোগিনী মন্ত্র ও নীল তন্ত্রানুসারে সম্পাদিত হয়। কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী তাঁর চণ্ডীমঙ্গল (অভয়ামঙ্গল) কাব্যে এই দেবী সম্পর্কে লিখেছেন :
'গোকুলে গোমতীনামা তাম্রলিপ্তে বর্গভীমা উত্তরে বিদিত বিশ্বকায়া।'
এটি প্রায় চারশ বছর আগের লেখা।
মন্দিরের স্থাপত্যরীতির বিবর্তন
[সম্পাদনা]বর্তমানে মন্দিরটির চারদিকে কিছু সংস্কার করা হলেও মূল প্রাচীন রূপটি অক্ষুণ্ণ। মন্দিরটি উচ্চতায় প্রায় ৬০ ফুট। এর দেওয়ালের ভেতরের প্রস্থ ৯ ফুট। এটি গোল ছাদ বিশিষ্ট। মন্দিরের চারটি অংশ—
- মূল মন্দির
- জগমোহন
- যজ্ঞ মন্দির
- নাট মন্দির।
তবে মনে হয় মন্দিরটির সব অংশ একসঙ্গে তৈরি হয়নি।
মন্দিরের বাইরের দেওয়ালে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেলীতে 27টি পোড়ামাটির বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি রয়েছে। এ মন্দির রেখা দেউল রীতির। এখনকার রূপ বিশ্লেষণ করলে মনে হয় দ্বাদশ বা ত্রয়োদশ শতাব্দীর কোনো এক সময় এ মন্দির নির্মিত হয়েছে।বর্তমানে এ মন্দিরের অনেক সংস্কার করা হয়েছে। বাইরের টেরাকোটার মূর্তিগুলি সিঁদুরে লেপটে গেছে। মূল দেবী মূর্তিও মুখোশ পরানোর ফলে আজ আর স্পষ্ট দেখা যায় না।
বাৎসরিক দুর্গোৎসব
[সম্পাদনা]দুর্গাপূজার সময় মহাধূমধাম সহকারে ষোড়শোপচারে পূজা করা হয়। মহাষ্টমীর লগ্নে বলিও দেওয়া হয়। বাইরের হাড়ি কাঠে লাল সিঁদুরের গভীর প্রলেপ রয়েছে। প্রতিদিন প্রহরে প্রহরে ভোগ দেওয়া হয়। এছাড়া বিবাহ অন্নপ্রাশন উপনয়ন এই সব বাঙালি অনুষ্ঠান এই মন্দিরে হয় মহাসমারোহে উদযাপিত হয়।
তথ্য়সূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ "Bargabhima Temple, Tamluk, Purba Medinipur, West Bengal"। ApniSanskriti (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৮-২৩।
- ↑ "তারা অঙ্গে শ্যামা আরাধনা তমলুকের বর্গভীমা মন্দিরে"। ১৯ অক্টোবর ২০১৭।
- ↑ "সতী পীঠের অন্যতম তমলুকের মা বর্গভীমা"। ১৫ অক্টোবর ২০১৭। ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা।
- ↑ "সতীর পীঠ তমলুকে বর্গভীমা পূজিতা হন দেবী উগ্রতারা রূপে"।
- ↑ সংবাদদাতা, নিজস্ব। "Short Trip: ভাঙেননি কালাপাহাড়, ভ্রমণ করেন নেতাজি, কী ভাবে যাবেন বর্গভীমা মন্দির"। www.anandabazar.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৮-২৩।
- ↑ Paul, Santanu (২০২০-১২-১৪)। "ONE OF 51 SHAKTI PEETH-BARGABHIMA KALI TEMPLE"। Bengal Chronicle (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৮-২৩।